শুদ্ধশব্দ

শুদ্ধশব্দ একটি বাংলা স্পেলচেকার। এটি ডেভালপ করা হয়েছে মাইক্রোসফট ওয়ার্ড অ্যাড-ইন হিসেবে। এর শব্দভাণ্ডারে রয়েছে ১, ০৬, ০০০ এরও বেশি শব্দ যা সম্পূর্ণ আধুনিক বাংলা বানানের নিয়ম অনুসারে প্রণীত । স্পেলচেকারটি এই স্বল্প পরিমান শব্দ দিয়েই বাংলায় সম্ভব এমন কয়েকশো কোটি শব্দ নিখুঁতভাবে পরীক্ষা করতে পারে। ভুল হিসেবে চিহ্নিত শব্দর সম্ভাব্য সঠিক শব্দের পরামর্শ তালিকা তৈরি করতে স্পেলচেকারটি ধ্বনিতাত্ত্বিক, রূপতাত্ত্বিক, শব্দের সম্পাদনার দূরত্ব, ব্যবহারকৃত কিবোর্ড এবং ব্যাকরণসহ আরও অনেক বিষয়াদি বিবেচনা করে। পরামর্শের তালিকা প্রণয়নের পর সেগুলিকে আবার নৈকট্যের মাত্রা অনুসারে সাজায়। পরামর্শ তালিকা সাধারণত যথা সম্ভব সংক্ষিপ্ত রাখা হয়।

শনিবার, ১০ জুলাই, ২০১০

বাংলা বানান শৃঙ্খলা প্রদান, বাঙালির কর্তব্য

বাংলা ভাষা নিয়ে প্রত্যেক বাঙালিরই এক ধরনের অহংকার রয়েছে, তার লিপি নিয়ে রয়েছে নিজস্ব ব্যক্তিত্ব বোধ। এই প্রেক্ষিতে স্বাভাবিকভাবেই প্রশ্ন করা যায়, বাংলা ভাষার বানান নিয়ে প্রত্যক বাঙালির অহংকার অথবা নিজস্ব ব্যক্তিত্ব বোধের কোনো সুযোগ আছে কী? আমরা যে ভাষাকে এত ভালোবাসি এবং যার জন্য আমাদেরকে রক্তও দিতে হল সেই ভাষার একটি সুসংহত লিখিত রূপ নেই তা কী আমাদের জন্য অহংকারের? আমরা এত বিচিত্র সব বানান লিখি যা আমাদেরকে বিশৃঙ্খল হিসেবেই প্রমাণ করে। এই বিশৃঙ্খলতা আমাদেরকে শুধু হেয় নয় আমাদের জ্ঞান চর্চার পথেও বড় এক বাধা।

বাংলা বানানের বিশৃঙ্খল অবস্থা অবসানের জন্য ভুক্তভোগী রবীন্দ্রনাথের অনুরোধের প্রেক্ষিতে কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয় রাজশেখর বসুর সভাপতিত্বে একটি কমিটি গঠন করে। সেই কমিটি ১৯৩৬ সালের মে ও অক্টোবর মাসে বানান সম্পর্কিত পুস্তিকার প্রথম ও দ্বিতীয় সংস্করণ এবং ১৯৩৭ সালে তৃতীয় সংস্করণ প্রকাশ করে। এই প্রচেষ্টা ছিল সেই সময়ের প্রেক্ষিতে বিপ্লবাত্মক যদিও এর ভূমিকায় উল্লেখ ছিল যে-সমিতি কেবল যে সব বানানে ঐক্য নাই সে সকল বানান যথাসম্ভব নির্দিষ্ট করা এবং যদি সম্ভব হয় তবে কোনো কোনো স্থলে প্রচলিত বানান সংস্কার করা। তারপর সময়ের বিবর্তনে সংহত বানানের জন্য সচেতনতার বৃদ্ধির ফলে বাংলা বানান বিষয়ক বিভিন্ন প্রতিষ্ঠান বেশ সুসংহত বানানবিধি প্রণয়ন করেছে। এর মধ্যে ১৯৮৮ সালে বাংলাদেশ পাঠ্য পুস্তক বোর্ডের বাংলা বানানের খসড়া, বাংলা একাডেমী প্রমিত বাংলা বানানের নিয়ম, পশ্চিমবঙ্গ বাংলা আকাদেমির বাংলা বানানের সমতাবিধান এবং লিখনরীতি ও লিপির সরলীকরণ সুপারিশপত্র এবং শিশু সাহিত্য সংসদ ও সাহিত্য সংসদ প্রকাশন সংস্থার বাংলা বানানবিধি উল্লেখ যোগ্য। বর্তমানে অনেক সংবাদপত্র ও প্রকাশনা সংস্থাকেও নিজস্ব বানানবিধি প্রণয়ন করতে এবং তা তাদের প্রকাশনার জন্য ব্যবহার করতে দেখা যায়। অবশ্য একটি সুসংহত মান্য বানানবিধি অপেক্ষা এত বানানবিধি আমাদের জন্য অকল্যাণকর বটে।

এতগুলি বানানবিধি থাকা সত্ত্বেও বাংলা বানানের অবস্থার খুব উন্নতি ঘটেছে এরকম মন্তব্য করা অনুচিত হবে। দৃষ্টান্ত হিসেবে ‘বাংলা একাডেমী ব্যবহারিক বাংলা অভিধান’(ফেব্রুয়ারি ২০০২ সংস্করণ) এর পরিশিষ্টে ছাপানো বাংলা একাডেমী প্রমিত বাংলা বানানের দু-একটি বিষয় উল্লেখ করতে পারি। এই বানানের নিয়মের ২.০১ অংশে স্পষ্ট বিধান দেওয়া হয়েছে যে-সকল অ-তৎসম শব্দে ই এবং উ এবং এদের কার চিহ্ন ি ু ব্যবহৃত হবে এবং কেবল কিছু স্ত্রীবাচক শব্দের শেষে ঈ-কার ব্যবহারের ঈষৎ অনুমতি দেওয়া হয়েছে। অথচ মুদ্রিত বানানের নিয়মটির সর্বত্র ‘দেশী’ এবং ‘বিদেশী’ শব্দ দুটিতে এ নিয়মের বিরুদ্ধে ঈ-কার ব্যবহার করা হয়েছে। ৪.০১ অংশে অ-তৎসম শব্দের উদাহরণে লন্ঠন, গুন্ডা, প্যান্ট ইত্যাদি শব্দের সাথে সংস্কৃত ঘণ্টা শব্দ ব্যবহার করা হয়েছে। এই সব প্রমাণ করে বানানের নিয়ম এবং তার সচেতন প্রয়োগের দূরত্ব। এ বিষয়ে পবিত্র সরকারের মন্তব্যটি উদ্ধৃত করা যেতে পারে “কিন্তু লিখন-সমর্থ আবালবৃদ্ধবনিতাকে দিয়ে সেই সিদ্ধান্তের (বানান বিষয়ক সিদ্ধান্ত) প্রত্যেকটি সূত্র স্বীকার ও পালন করানো, সে প্রায় অসম্ভব কাজ। অন্তত এই অর্ধশতাব্দীর বেশি সময়ের মধ্যে আমরা তো সে কাজ করে উঠতে পারলাম না। আরও অর্ধশতাব্দী এরকম প্রায় নিষ্ফলা গেলেও অবাক হবার কিছু নেই। কারণ এ পর্যন্ত অভিজ্ঞতা বলে, সংস্কারে আমরা যত উৎসাহী সম্প্রসারে ততটা নই। সহজ কাজটা আমরা হট্টগোল করে করি, কঠিন কাজটার বেলায় নিঃশব্দ থাকি।”

বানানবিধিতে বিকল্প বানানের সুযোগ, প্রণীত বানানবিধিগুলির মধ্যে বিরোধ, লেখক, শিক্ষক ও গুরুজনদের এক সময় শেখা বানান নিজেরা না ভোলা এবং অন্যদেরকে ভুলতে না দেওয়া, আমাদের অজ্ঞতা ও নিজ ভাষার বানানের বিষয়ে উদাসীনতা-এই সুযোগে আমাদের বাংলা বানান হয়ে গেছে নিয়মরহিত, বিশৃঙ্খল ও বিভিন্ন রূপী। তবে প্রথম ও দ্বিতীয় কারণ দুটির ক্ষেত্রে কিছু বলা প্রয়োজন। বানানবিধিগুলিতে যে বিকল্প বানানের কথা বলা হয়েছে তার সংখ্যা খুব বেশি নয় এবং বানানবিধিগুলিতে যে বিরোধ তা সামান্য। কিন্তু দুটি বিষয়ই আমাদের কাছে প্রচুর হিসেবে দেখা দেয় এবং আমরা সেই সুযোগে নিয়ম সম্পর্কে যথেষ্ট না জেনেই নিয়মের দোহাই দিয়ে ভুল করতে থাকি। যেমন: পশ্চিমবঙ্গ এবং বাংলা একাডেমীর মধ্যে অনেক পার্থক্য রয়েছে এরকম একটা ধারণা থেকেই সম্ভবত অনেকে ‘রাখবো’ ও ‘শুনলো’ এর মতো বানান লেখেন যা দুটির কোনোটিই সমর্থন করে না।

আমরা যদি মনে করি ভাষার মতো বানানও নদীর গতিপথের মতো স্বেচ্ছাচারী এবং এই স্বেচ্ছাচার করা এই ভাষাভাষী জাতি হিসেবে আমাদের অধিকার তাহলে আমাদের জন্য তা হবে অনেক বড় ভুল। প্রকৃত পক্ষে ভাষা নদীর গতিপথ ও স্রোতের মতো হলেও তার বানান অবশ্যই হতে হবে বিজ্ঞানের সূত্রবদ্ধ।

শব্দ রহস্যময় কোনো অলৌকিক পদার্থ নয় এটি একটি জাগতিক ব্যাপার এবং শব্দের বানান একটি জাগতিক অভ্যাস। পরী যদি পরি হয় তবে তার রূপ-মাধুরী কোনো পরিবর্তন ঘটবে না, কাহিনি বানানে ঈ-কার না হলেও তা ঘটনার বৃত্তান্তই বোঝাবে, শ্রেণি ঈ-কার না থাকলে তার অর্থ বিভাগ থাকবে-শুধু আমাদের জাগতিক অভ্যাসের কিছু পরিবর্তন ঘটাবে। আমাদের বানানকে শৃঙ্খলা প্রদানের কাজ সহজ হবে।

সুতরাং বাংলার ভাষার একটি সংহত লিখিত রূপের জন্য আমাদের উচিত বানান বিষয়ক অপ্রয়োজনীয় সংস্কার ত্যাগ করা এবং নতুন বানান গ্রহণ করার ইচ্ছা পোষণ ও উদ্যোগ নেওয়া। আমরা যদি আমাদের ভাষার লিখিত রূপকে সুসংহত করার প্রচেষ্টায় পিছিয়ে থাকি তবে এই প্রয়োজনকে অন্য কোনো জাতি এসে বাস্তবায়িত করবে না। অনেক সময় আমাদের পেরিয়ে গেছে-এভাবে আরও অনেক সময় পার করা অসম্ভব কিছু নয়। কিন্তু ভাষার লিখিত রূপকে সুসংহত করার জন্য আমাদের ধীর গতি প্রয়োজনের তুলনায় অতি বেশি ধীর। একটি ভাষাজাতি হিসেবে যে বিশৃঙ্খলা আমরা লালন করছি তা কেবল আমাদের সম্মিলিত প্রচেষ্টাতেই সমাধান হতে পারে।

যেহেতু বাংলা বানানের শৃঙ্খলা নির্ভর করছে আমাদের অভ্যাসের উপর-আমাদের সুসংহত বানান অভ্যাসই বাংলা ভাষার সুসংহত লিখিত রূপ। তাই বানানের বিষয়ে ভাষাবিজ্ঞানীদের নিরলস গবেষণা লব্ধ জ্ঞানকে শ্রদ্ধা জানিয়ে তাদের মতানুসারে লিখন অভ্যাস গড়ে তোলাই আমাদের কর্তব্য। আমাদের বলতে সম্পূর্ণ বাঙালি জাতির।

২টি মন্তব্য:

  1. আপনার তথ্যপূর্ণ লেখার জন্য ধন্যবাদ। বুঝতে পারছি বিষয়টা গুরুত্বপূর্ণ। গুরুজনেরা দয়া করে একটু ভেবে দেখবেন।

    হিমেল

    উত্তরমুছুন
  2. গরুজনদের অবশ্যই ভাবা উচিৎ কর্তব্য কর্ম নিয়ে। তবে যার যার অবস্থান থেকে সকলেই যদি ভাবে তবে একটু বেশি ভালো হয়।

    ধন্যবাদ.

    উত্তরমুছুন